জলদূষণ কাকে বলে? জলদূষণের কারণ, ফলাফল ও প্রতিকার
Table Of Contents
ভূমিকাঃ জলই জীবন শতাব্দী-প্রাচীন এই প্রবাদের সত্যতা বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যে প্রাকৃতিক সম্পদগুলি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় জল তাদের অন্যতম। সব ধরণের প্রাণীর জীবন রক্ষার অন্যতম উপকরণ হিসেবে, খাদ্য উৎপাদন বা আর্থিক সমৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক হিসেবে জল অপরিহার্য হলেও এই একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যমানুষের সামনে এক ভয়াবহ বিপদ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে জল-দূষণ। পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল হলেও পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠের মাত্র ০.৫% স্থান বিশুদ্ধ জলে পূর্ণ। মাত্র ০.১% নদী সমূহ দ্বারা আবৃত। মোট জলরাশির মাত্র ০.০১% নদীর জল। অর্থাৎ মানুষের সংখ্যা বিচার করলে পৃথিবীতে যে পরিমাণ বিশুদ্ধ জল আছে তা যথেষ্ট নয় ফলে জলদূষণ বিষয়টি যে অত্যন্ত উদ্বেগের সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
জলদূষণ কাকে বলে বা জলদূষণ বলতে কী বোঝ?
জলের ভৌত, রাসায়নিক অথবা জৈবিক বিকৃতিকে জলদূষণ বলে যা সংঘটিত হয় জলের সঙ্গে ক্ষতিকর বস্তুসমূহের মিশ্রিত হবার কারণে। মাটির নীচে সঞ্চিত জলকে ভৌমজল বলে এ-ছাড়া পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠে পুকুর, খাল, বিল, নদী, হ্রদ ও সমুদ্রেও রয়েছে বিস্তৃত জলরাশি। এই উভয় প্রকার জলই তাদের নিজস্ব ধর্ম হারায় যখন তারা নানা কারণে দূষিত হয়ে পড়ে।
জল দূষণের ৫টি কারণ লেখ।
ভৌমজল যে সব কারণে দূষিত হতে পারে তা হল :-
১। মনুষ্যকৃত ক্রিয়াকলাপ
- (ক) পাম্পের সাহায্যে প্রচুর জল তুলে নেওয়া, বর্জ্য পদার্থ মাটিতে পুঁতে দেওয়া।
- (খ) নগরায়নের কারণে অসংখ্য সেপ্টিক ট্যাংক নির্মাণ।
- (গ) প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার।
- (ঘ) খনি থেকে ধাতু উত্তোলনের জন্য গভীর খনন কার্য।
- (ঙ) বিরাট স্থান জুড়ে কবরখানা প্রভৃতি নির্মাণ।
২। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপ
- (ক) প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মাটির স্তরসমূহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভৌমজল দূষিত হতে পারে।
- (খ) আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে উদ্গত বিষাক্ত গ্যাস বৃষ্টির সঙ্গে মিশে জলের উৎসের সঙ্গে মিলিত হয়ে জলদূষণ ঘটায়।
- (গ) মাটিতে কোন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ মিশে গেলে বা ইউরানিয়াম প্রভৃতি তেজষ্ক্রিয় ধাতুর বিকিরণের ফলেও ভৌমজল দূষিত হয়।
মনে রাখা দরকার ভৌমজলের দূষণ সহজে ধরা পড়ে না এবং এর প্রতিকার মোটেই সহজ নয়।
ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের জল দূষিত হয়ঃ মনুষ্যকৃত ক্রিয়াকলাপের ফলে অথবা সময়োচিত প্রতিকার না করার কারণে যথা,
(ক) পুকুর বা খালের জল দূষিত হয় যখন সেখানে গৃহস্থালীর যাবতীয় বর্জ্য পদার্থ ফেলা হয় অথবা ড্রেনযোগে ময়লা জল সেখানে ফেলা হয়।
(খ) নদীর জল দূষিত হয় যখন তীরভূমির যাবতীয় ময়লা জল তাতে মেশে এবং তীরভূমির মানুষ ও কলখারখানাগুলি তাদের যাবতীয় বর্জ্যপদার্থ নদীতে নিক্ষেপ করে।
(গ) ক্ষতিকর পদার্থের সঙ্গে জলের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে জলের স্বাভাবিক গুণ নষ্ট হয়ে তা দূষিত হয়ে পড়ে।
(ঘ) অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্প-কলকারখানা, হাসপাতাল প্রভৃতির দূষিত বর্জ্যপদার্থ, জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রভৃতি খাল ও নদীর জল দূষিত করে।
জলদূষণের প্রভাব বা তার ফলাফল
(ক) এর ফলে জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের মৃত্যু হয়।
(খ) পানীয়জল দূষিত হলে তা থেকে ডায়েরিয়া, আন্ত্রিক, কলেরা, টাইফয়েড প্রভৃতি নানা রোগ দেখা দেয়। এই কারণে কোথাও বন্যা হলে তারপরই মহামারীর প্রকোপ দেখা দেয়।
(গ) দূষিত জলে উপস্থিত রাসায়নিকের সংস্পর্শে বিভিন্ন ত্বকের রোগ, লিভার বা কিডনীর রোগ হতে পারে। দূষিত জল থেকে জন্ডিস হতে পারে।
(ঘ) জলে পারদ মিশে গেলে তা থেকে স্নায়বিক রোগ দেখা দেয়।
(ঙ) জলে আর্সেনিক দূষণ হলে তা শারীরিক বিকৃতির কারণ অথবা প্রাণঘাতী হতে পারে। বর্তমানে ভারতে এবং বাংলাদেশে এই আর্সেনিক দূষণের প্রাবল্য দেখা দিয়েছে।
(চ) জলদূষণের আর একটি বিপদ হল এর ফলে ফসফেট এবং নাইট্রেট দূষণ হয়ে জলে শৈবাল বৃদ্ধি পায়। এই শৈবাল দ্রুত জলের অক্সিজেন শোষণ করায় জলজ প্রাণীর অক্সিজেনের অভাব ঘটে এবং তাদের মৃত্যু হয়।
(ছ) জলদূষণের ফলে জলজ প্রাণীর জীবনের সংকট উপস্থিত হলে বাস্তুতন্ত্র ভারসাম্য হারায়।
জলদূষণের প্রতিকার
নিম্নলিখিত উপায়গুলি প্রতিকারের জন্য অবলম্বন করা আবশ্যক :-
(ক) লোকালয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় জলের উৎসগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গণসচেতনতা তৈরী করতে হবে।
(খ) বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে জলদূষণের প্রতিকার সম্ভব নয়। শিল্প ও নগরের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলের চাহিদা বাড়বে। বর্তমানে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান এবং ন্যাশনাল রিভার অ্যাকশন প্ল্যান মাফিক জলশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিথিলতার কোন অবকাশ নেই। এই বৃহত্তর ক্ষেত্রেও ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তুলে সমস্যার সমাধানের জন্য অগ্রসর হতে হবে।
(গ) ভৌমজলের অপচয় বন্ধ করে বৃষ্টির জল সংরক্ষনকারী ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
(ঘ) নদীর জল শুদ্ধ করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহারে জোর দিতে হবে।
(ঙ) এছাড়া নুতনভাবে অরণ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ, জৈবসার ব্যবহারে জোরদেওয়া, শিল্পের ক্ষেত্রে দূষণ সংক্রান্ত আইন কঠোরভাবে বলবৎ করার মধ্য দিয়ে এবং বিজ্ঞানজাত শক্তি দিয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় সমস্যাটি যেহেতু বিশ্বব্যাপী তাই বিশ্বকে একজোট হয়ে এই ব্যাপারে পারস্পরিক জ্ঞান ও সাফল্যের সূত্র বিনিময় করতে হবে। সমবেত প্রচেষ্টায় অবশ্যই সাফল্য আসবে। যেহেতু সমস্যাটি গভীর এবং সুদূরপ্রসারী তাই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলিও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়া প্রয়োজন।
প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলে কোনো অবাঞ্ছিত পদার্থ মিশলে জলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন হয় তাকে জল দূষণ বলে।
১.শিল্পকারখানার বর্জ্য: কলকারখানা থেকে নিষ্কাশিত বিষাক্ত রাসায়নিক, ভারী ধাতু, এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ জলাশয়ে মিশে জল দূষিত করে।
২.কৃষি কাজ: কৃষিক্ষেত্র থেকে ধুয়ে আসা সার, কীটনাশক, এবং জৈব বর্জ্য জলাশয়ে মিশে জলের গুণমান নষ্ট করে।
৩.গৃহস্থালীর বর্জ্য: রান্নাঘরের বর্জ্য, সাবান, ডিটারজেন্ট, এবং অন্যান্য দৈনন্দিন বর্জ্য জলাশয়ে মিশে জল দূষিত করে।
৪.মানব মলমূত্র: নর্দমা ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে মানব মলমূত্র জলাশয়ে মিশে জল দূষিত করে।
১.বাড়ির আবর্জনা সঠিক জায়গায় ফেলা।
২.জল সাবধানে ব্যবহার করা।
৩.বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে সেগুলো কাজে লাগানো।
৪.পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানো।