শব্দ কাকে বলে? শব্দ কয় প্রকার ও কি কি? উদাহরণ দাও।
শব্দ কাকে বলে বা শব্দ বলতে কী বোঝ?
নাম পদের বিভক্তিহীন মূল অংশই শব্দ। প্রতিটি শব্দই অর্থবাচক হওয়া চাই। অর্থাৎ কতগুলো বর্ণ বা বর্ণ সমষ্টি পাশাপাশি বসে যখন একটি অর্থ প্রকাশ করে তখন তাকে শব্দ বলে।
যেমন - 'কলম' শব্দটি ক, ল, ম এই তিনটি বর্ণ পাশাপাশি বসে একটি অর্থ প্রকাশ করেছে। এই 'কলম' শব্দটির অর্থ হলো যার দ্বারা আমরা লিখি। এই তিনটি বর্ণ কে যদি আবার একটু উল্টে লিখি 'লকম' এই শব্দটি পাশাপাশি বসলেও কোন পরিপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করেনি। তাই এটি কে আমরা শব্দ বলতে পারি না।
অর্থাৎ শব্দ সেটি, যেটি একটি অর্থ প্রকাশ করে। অর্থহীন সংযোগে কখনোই শব্দ গঠিত হয় না।
শব্দ কয় প্রকার ও কী কী?
শব্দকে প্রধানত তিন ভাবে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যেমন -
১.উৎপত্তিগত দিক থেকে শ্রেণীবিভাগ।
২.অর্থগত দিক থেকে শ্রেণীবিভাগ ।
৩.গঠনগত দিক থেকে শ্রেণীবিভাগ।
উৎপত্তিগত দিক থেকে শব্দ কয় প্রকার ও কী কী?
উৎপত্তিগত দিক থেকে শ্রেণীবিভাগ: উৎপত্তিগত দিক থেকে শব্দ পাঁচ প্রকার যেমন- তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি।
১. তৎসম শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
তৎসম শব্দটির অর্থ হলো 'তার সমান' অর্থাৎ, তৎ=তার (সংস্কৃত), সম = সমান। তার সময় সমান। অর্থাৎ সংস্কৃতের সমান। যে সমস্ত শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে কোন পরিবর্তন ছাড়াই সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে সেই শব্দগুলিকে তৎসম শব্দ বলে। বাংলা শব্দ ভান্ডারের প্রায় অর্ধাংশ এই তৎসম শব্দপুষ্ট। যেমন-শিক্ষক, পিতা, মাতা, মস্তক ইত্যাদি।
২. অর্ধ-তৎসম শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ প্রাকৃতিকের পথ না ধরে সরাসরি বাংলা ভাষায় আসতে চেয়েছে অথচ তৎসম শব্দের মত নিজের রূপটি অটুট রাখতেও পারে নি। অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দ সাংস্কৃত থেকে কিঞ্চিত পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত শব্দের সেই বিকৃত রূপকেই অর্ধ তৎসম শব্দ বলে। যেমন -কৃষ্ণ - কেষ্ট, তৃষ্ণা - তেষ্টা, কীর্তন-কেত্তন।
৩. তদ্ভব শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
'তদ্ভব' শব্দের অর্থ হলো ,তদ্-সংস্কৃত, ভব- উৎপন্ন, অর্থাৎ -'সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন'। যে সমস্ত শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে প্রাকৃত এবং অপভ্রংশের মাধ্যমে তার রূপকে পরিবর্তিত করে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে তাকে তদ্ভব শব্দ বলে যেমন- চন্দ্র >চান্দ>চাঁদ, হস্ত> হত্থ>হাত ,বধূ >বহু >বউ।
৪.দেশী শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে সমস্ত শব্দ প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল । বাংলাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন- কোল, ভিল, সাঁওতাল, দ্রাবিড় - এই সমস্ত জাতির কাছ থেকে এই শব্দগুলো জ্ঞাত মূলক বা অজ্ঞাতমূলক যে সমস্ত শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে। অর্থাৎ অনার্য জাতির কাছ থেকে কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই বাংলা শব্দ ভান্ডারে যে শব্দগুলি এসেছে সেগুলি দেশি শব্দ। যেমন- খোকা, ছানা, ঢোল, ঝাঁটা, মুড়ি, পাঁঠা, থোড়, ডাব, ডোবা, পাঁঠা, পেট ইত্যাদি।
৫. বিদেশি শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
ভারতবর্ষের বাইরের দেশ থেকে অথবা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক ,অর্থনৈতিক ,সংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিদেশীরা এদেশে এসেছে। তাদের কাছ থেকে যে শব্দগুলো স্বরূপে বা কিঞ্চিত পরিবর্তিত রূপে বাংলা শব্দ ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করেছে সেই শব্দগুলোকে বিদেশি শব্দ বলে। আগন্তুক শব্দগুলির মধ্যে বহিঃ ভারতীয়- ইংরেজি ,আরবি ,ফার্সি ও পর্তুগিজ শব্দই সংখ্যায় বেশি আর আন্ত:ভারতীয় প্রতিবেশী শব্দগুলির মধ্যে হিন্দির আধিক্যই উল্লেখযোগ্য। উদাহরণ - সিনেমা, চা, চিনি, লুঙ্গি ,নাশপাতি, জামা ,তারিখ ,খবর ,রেস্তরা ইত্যাদি। এছাড়াও আরেকটি শব্দ রয়েছে যাকে আমরা বলি মিশ্র শব্দ।
২.অর্থগত দিক থেকে শব্দ কয় প্রকার ও কী কী?
অর্থগত দিক থেকে শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা - ১.যৌগিক শব্দ, ২.রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ, ৩.যোগরূঢ় শব্দ।
১.যৌগিক শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে সমস্ত শব্দ প্রকৃতি এবং প্রত্যয় এর অনুগামী হয় অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও প্রচলিত অর্থ এক তাদেরকে আমরা বলি যৌগিক শব্দ। বাংলা ভাষায় যৌগিক শব্দের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। যেমন - কৃ ধাতুর অর্থ করা ; অনীয় প্রত্যয়টি উচিত অর্থে প্রযুক্ত হয়। এখন উভয়ের সম্মেলনে করণীয় শব্দটির সৃষ্টি। এই শব্দটির অর্থ 'করা উচিত'। এই অর্থটি প্রকৃতি প্রত্যয়ের সম্মিলিত অর্থের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। অতএব করণীয় শব্দটি যৌগিক।
২. রূঢ় শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে সমস্ত শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এক এবং প্রচলিত অর্থ আলাদা। অর্থাৎ যে সমস্ত শব্দ প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থের অনুগামী না হয়ে অন্য কোন অর্থ প্রকাশ করে সেই শব্দগুলিকে বলে রূঢ় বা রূঢ়ী শব্দ। যেমন - 'মন্ডপ' শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থ 'মন্ড বা ফ্যান পান করে যে ' কিন্তু 'মণ্ডপ' শব্দটির এই অর্থ কোথাও প্রযুক্ত হয় না। প্রচলিত অর্থ হল দেবালয় বা গৃহ। অথচ দেবালয় বা গৃহের সঙ্গে ফ্যানের কোন সম্পর্ক নেই।
৩. যোগরূঢ় শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে সকল শব্দ প্রকৃতি - প্রত্যয়গত অর্থগুলির মধ্যে একটি বিশেষ অর্থেই প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ যে সমস্ত সমাসনিস্পন্ন শব্দ তার সমসমান পদগুলির অনুগামী না হয়ে অন্য কোন অর্থ প্রকাশ করে তাকে যোগরূঢ় শব্দ বলে।
একাধারে যৌগিক ও রুঢ় বলে নাম যোগরূঢ়। প্রকৃতি প্রত্যয়গত অর্থের সহিত যোগ থাকায় যৌগিক। অথচ প্রত্যয়জাত অর্থগুলির মধ্যে একটি বিশেষ অর্থে সীমাবদ্ধ বলে রূঢ়। যেমন- পঙ্কজ (পঙ্ক-জন+ ড) শব্দটির প্রকৃতি প্রত্যয়জাত অর্থ - 'যাহা পঙ্কে জন্মে'। পাঁকে শ্যাওলা, শামুক , শালুক, পাঁকাল, পদ্ম অনেক কিছুই জন্মায়। অথচ পঙ্কজ শব্দটির অর্থ কেবল পদ্মফুলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। পদ্ম পংকে জন্মে তাই পঙ্কজ যৌগিক। আবার পঙ্কজ শব্দটি অন্য সমস্ত অর্থ বাদ দিয়ে মাত্র পদ্ম অর্থই লোকো প্রসিদ্ধ হওয়ায় শব্দটি রূঢ় ও বটে।
গঠনগত দিক থেকে কত প্রকার ও কী কী?
গঠনগত দিক থেকে শব্দ দুই প্রকার ।
১.মৌলিক শব্দ ।
২.সাধিত শব্দ ।
১.মৌলিক শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
যে শব্দকে বিশ্লেষণ করা যায় না তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন - মা, ভাই ,হাত,পা, নাক ,কান ,ঘোড়া ,উট ,এক, দুই ইত্যাদি। প্র,পরা, অপ,সম,নি ,অব প্রভৃতি উপসর্গগুলিও মৌলিক শব্দ। কারণ এদের নিজস্ব অর্থ আছে এবং এদের বিশ্লেষণ ও করা যায় না। বাংলায় ব্যবহৃত বিদেশী শব্দগুলিকে বিশ্লেষণ চলে না। তাই তাদের মৌলিক শব্দ বলে গণ্য করা হয়। যেমন - বাস ,রেল ,পেন্সিল ,টেবিল, সিনেমা, বেহালা ইত্যাদি ।
২.সাধিত শব্দ কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
সমাসের দ্বারা গঠিত অথবা ধাতু বা শব্দের উত্তর প্রত্যয় যোগে গঠিত শব্দকে সাধিত শব্দ বলে। সাধিত শব্দ মাত্রই বিশ্লেষণযোগ্য। উদাহরণ- লজ্জার সহিত বিদ্যমান=সলজ্জ্ব। কলমেওকলমে= কাগজে-কলমে ।এগুলি সমাসের সাহায্যে গঠিত সাধিত শব্দ । গম্ + অনট্ = গমন। কৃৎ প্রত্যয় যোগে সাধিত শব্দ।
শব্দ ও পদের মধ্যে পার্থক্য লেখ।
শব্দ | পদ |
অর্থবোধক ধ্বনি হল শব্দ । | বিভক্তিযুক্ত শব্দ হল পদ। |
বাক্যে স্থান লাভের যোগ্যতা শব্দের নাই। | বাক্যে স্থান লাভের যোগ্যতা কেবল পদের আছে। |
প্রত্যেকটা নাম পদ মূলত শব্দ। | কেবল শব্দ পদাপি পদ নয় । |
উদাহরণ -চাষি, মাঠ ইত্যাদি । | উদাহরণ -চাষি মাঠে চাষ করে। |
ভাষাবিজ্ঞানীরা শব্দের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। কয়েকটি সংজ্ঞা হল:
[1] শব্দ হল এমন এক ধ্বনিসমষ্টি যা স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশ করে এবং বাক্যের একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
[2] শব্দ হল ভাষার মৌলিক একক যা একটি বাক্যের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং একটি স্বতন্ত্র অর্থ প্রকাশ করে।
[3] শব্দ হল এমন একটি ধ্বনিসমষ্টি যা একটি বাক্যে একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে এবং অন্যান্য শব্দের সাথে মিলিত হয়ে একটি বাক্য গঠন করে।
• শব্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর অর্থবোধকতা। একটি শব্দের অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট অর্থ থাকতে হবে।
• শব্দের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর এককতা। একটি শব্দকে এক বা একাধিক শব্দে বিভক্ত করা যায় না।
• শব্দের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল এর বাক্যাংশগত প্রকৃতি। একটি শব্দ একটি বাক্যের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।