শব্দ দূষণ কাকে বলে? শব্দ দূষণের কারণ, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের উপায়।
দূষণের ধারনা বা ভূমিকা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ যতই সভ্যতার পথে অগ্রসর হচ্ছে ততই মানব সভ্যতা এক ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। এমনই এক সমস্যা হল পরিবেশ দূষণ। অতীতকালে পরিবেশ ছিল বিশুদ্ধ কিন্তু সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দাবানল, অগ্নুৎপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণ এবং অরণ্য ধ্বংস, জনবসতি বেড়ে যাওয়া, প্রচুর কলকারখানা, যানবাহন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি মানুষ ও সৃষ্ট কারণে প্রকৃতি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ - জল, বায়ু, মাটি প্রবল ভাবে দূষণের কবলে পড়েছে। এখানে আমরা শব্দ দূষণ সম্পর্কে জানব।
শব্দ দূষণ কাকে বলে বা শব্দ দূষণ বলতে কী বোঝ?
সংজ্ঞা:- মানুষের সহন ক্ষমতার অতিরিক্ত যে সুর বর্জিত কর্কশ শব্দ পরিবেশ, মানুষের শরীর ও মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে তাকে শব্দ দূষণ বলে। শব্দ দূষণ মাপার এককের নাম হলো 'বেল'। এই এককটির আবিষ্কারক হলেন গ্রাহাম বেল। শব্দ দূষণের মাত্রা মাপার একক হল - dB (ডেসিবেল)।
শব্দ দূষণের উৎস:
শব্দ দূষণের উৎস: শব্দ দূষণ এর উৎপত্তির যে দিকগুলি আমরা পাই সেগুলি হল
১. প্রাকৃতিক উৎস: বজ্রপাত, মেঘের গর্জন.
২. মনুষ্য সৃষ্ট উৎস: উচ্চস্বরে কথা বলা, ট্রেনের হুইসেল।
শব্দ দূষণের কারণগুলি লেখ।
শব্দ দূষণের যে কারণগুলি রয়েছে সেগুলি হল নিম্নলিখিত :-
১.যানবাহন: বিভিন্ন যানবাহনের হরণের তীব্র আওয়াজ শব্দ দূষণের একটি কারণ। এই যানবাহন গুলি রয়েছে তিন ধরনের :-
- আকাশ পথ:- আকাশ পথে যে যানবাহন গুলি শব্দ দূষণের কারণ সেগুলোর মধ্যে হলো হেলিকপ্টার ,এরোপ্লেন, জেট বিমান ।এই জেট বিমান আকাশ পথে যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে।
- জল পথ:- জল পথের যানবাহন গুলি হল - জাহাজ, স্টিমার, মেশিন দ্বারা চালিত লঞ্চ।
- স্থলপথ:- স্থলপথের যানবাহন গুলির মধ্যে গাড়ি, বাইক, ট্রাক, রেল প্রভৃতি হর্ণের আওয়াজ শব্দ দূষণের কারণ।
২. শিল্প :- বিভিন্ন কলকারখানাতে যন্ত্রের আওয়াজ শব্দ দূষণের একটি অন্যতম কারণ। শব্দ দূষণ সৃষ্টিকারী উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারখানা হল - ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা, টেক্সটাইল লুম, নিউজ পেপার প্রেস, গাড়ি সারাই কারখানা ইত্যাদি।
৩. সামাজিক কাজকর্ম :- সামাজিক যে কাজকর্ম গুলি শব্দ দূষণের কারণ তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সম্মেলন, মিটিং মিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ, বিভিন্ন আন্দোলন, বিবাহ অনুষ্ঠান, অন্নপ্রাশন, রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মাইক, ব্যান্ড পার্টি, ডিজে শব্দ দূষণের কারণ।
৪. শব্দ বাজি :- বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পুজো অনুষ্ঠান, বিবাহ অনুষ্ঠান ও আনন্দ উৎসব অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন উপলক্ষে ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শব্দবাজির কারণে শব্দ দূষণ হয়ে থাকে।
৫. নির্মাণ কাজ :- গৃহ নির্মাণ, অফিস আদালত, কলকারখানা নির্মাণ, জাহাজ নির্মাণ, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরিতে উৎপন্ন শব্দ পরিবেশ দূষণের একটি কারণ।
৬. জেনারেটর :- বিদ্যুৎ চালিত জেনারেটর- অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন দপ্তরে ব্যবহৃত হয় এ ক্ষেত্রেও যে শব্দ তা পরিবেশ দূষণের একটি কারণ হতে পারে।
৭. উচ্চস্বরে হইচই :- সামাজিক বিভিন্ন কলহ, চিৎকার, চেঁচামেচি, জনগণের উল্লাস ক্রমাগত হলে তা শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
শব্দ দূষণের প্রভাব বা ফলাফলগুলি লেখ।
শব্দ দূষণের ফলে যে প্রভাব গুলি আমরা দেখতে পাই তা খুবই ক্ষতিকারক পরিবেশের ক্ষেত্রে এবং মানুষের ক্ষেত্রে। শব্দ দূষণের মাত্রা নির্ণয় বিভিন্ন সংস্থায় বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। তার মধ্যে WHO এর মতে অথবা CPCB(সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড ) এর মতে নির্ধারিত শব্দের মাত্রা ৭০dB। তবে বর্তমানে শব্দ দূষণের মাত্রা ৭০ dB এর থেকে অনেক বেশি হচ্ছে। তাই এর ফলে যে প্রভাব গুলি লক্ষিত হয় সেগুলি হল :-
১. মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন :- ৬০ dB এর বেশি হলে আওয়াজ আমাদের হৃদপিন্ডের মায়োকার্ডিয়াল পেশিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২. উচ্চ রক্তচাপ :- ৯০ dB এর বেশি আওয়াজ আমাদের হৃদপিন্ডের রক্তের গতিবেগ বাড়িয়ে দেয় এবং উচ্চ রক্তচাপ বা high blood pressure তৈরি করে। এর ফলে ক্যালসিয়াম হ্রাস পায়। গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস পায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ধমনীর রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়।
৩.NIHL :- 'Noise induced hearing loss' -কানের একটি অর্গান রয়েছে যা আমাদের শুনতে সাহায্য করে। সেই অর্গানের যে লোমকোষ গুলো রয়েছে তা এই শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শব্দের মাত্রা যদি ১০০ dB হয় তাহলে এই শব্দ আমাদেরকে অস্থায়ীভাবে বধির করতে পারে। এই শব্দ যদি ১৫০ dB হয়, তাহলে আমরা স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যাব।
৪. মানসিক অবসাদ :- অতিরিক্ত শব্দ আমাদের মানসিক অবসাদ যেমন - বিরক্ত ভাব, খিটখিটে মেজাজ, মনোযোগ বিনষ্ট হওয়া, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং অস্থিরতা তৈরি করে যা খুবই বিপদজনক।
৫.মস্তিষ্কের উপর প্রভাব :- উচ্চ ডেসিবেল যুক্ত শব্দ মানুষের মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাকান্ড কে প্রভাবিত করে। অনেক ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় ও মানসিক অবসাদ ঘটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিদ্রা ঘটে। স্বয়ংক্রিয় নার্ভ তন্ত্র কে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
৬. শ্বাসকার্যের উপর প্রভাব :- উচ্চ মাত্রা শব্দের প্রভাবে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার পরিবর্তিত হয় এর ফলে শ্বাসক্রিয়ার গভীরতা বৃদ্ধি পায় এবং শ্বাসগ্রহন ও শ্বাসত্যাগ দ্রুততর হয়।
৭. অন্যান্য প্রাণীদের উপর প্রভাব :-
- প্রজননে বাধা: যে সমস্ত প্রাণীরা শব্দ দূষণ এরিয়াতে থাকে তাদের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটে, অতিরিক্ত শব্দ তাদের প্রজননের পরিবেশ কে নষ্ট করে দেয়।
- ভ্রুনের বৃদ্ধি হ্রাস: শব্দ দূষণ এলাকায় থাকা প্রাণীদের ভ্রুনের বৃদ্ধি র হ্রাস হয়। উদাহরণ ইঁদুরের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।
- বধিরতা : ৮৫ dB শব্দে থাকা প্রাণীদের মধ্যে বধিরতা লক্ষ্য করা যায়।
- মাস্কিং : বিভিন্ন প্রাণীরা তাদের আত্মরক্ষা বা শিকারের জন্য আশেপাশের পরিবেশের বিভিন্ন ধরনের শব্দ বোঝার চেষ্টা করে। সাপের ক্ষেত্রে আমরা দেখি। তাদের জিভ বাইরে বের করে তালুতে স্পর্শ করে এবং পরিবেশের মধ্যে আত্মরক্ষা বা শিকার সম্পর্কিত ধারণা করতে পারে।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলি লেখ।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা : শব্দ দূষণ মূলত শিল্পায়ন এবং আধুনিক সমাজ সংস্কৃতির কুফল। প্রচন্ড, একঘেয়ে, বিরক্তিকর, কান ফাটানো , অস্বস্তিকর শব্দ মানুষের শরীরে নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে। কান ভো ভো করতে পারে, মাথার যন্ত্রণা হতে পারে, কানে শোনার ক্ষমতা কমে যেতে পারে, অন্য দরকারি কথা শোনার অসুবিধা হতে পারে, বিরক্তি আসতে পারে, মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে ইত্যাদি কত ধরনের অসুবিধা যে হতে পারে তার ঠিক - ঠিকানা নেই। মানুষের এই অসুবিধা বা সমস্যা দূর করার জন্য শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়:
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কতগুলো উপায় রয়েছে। এগুলি নিম্নে আলোচিত হলো-
১. আইনসম্মত উপায় : শব্দ দূষণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে যে দুটি মূল আইন বা বিধি কাজে লাগানো হয়। সেগুলি হল- ১.বায়ু দূষণ (প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮১ এবং ২.পরিবেশ (সংরক্ষণ )তৃতীয় সংশোধিত বিধি, ১৯৮৫.
সরকারি দপ্তরে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- মোটর ভেহিকেলস আইনে- বলা হয়েছে হর্ন বাজানো যাবে না। সাইলেন্ট জোন এরিয়াতে যেমন - হাসপাতাল ,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোট এলাকা গুলির বাইরে ৬৫ dB এর বাইরে শব্দ বাজানো যাবে না।
- রাত দশটার পর ডিজে বা বক্স বাজানো যাবে না।
- আতশবাজি ফায়ার ওয়ার্ক ৬৫ dB এর উপরে যেন না ফাটানো হয়। যথার্থ কারণ ছাড়া নিরিবিলি এলাকায় অযথা শব্দ দূষণ করা যাবে না।
- শিল্পাঞ্চলের চার ধারে গাছ লাগাতে হবে।
- শব্দ প্রতিরোধক ডিভাইস ব্যবহার করে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় যেমন - ears plug, ear muf,channel plug ইত্যাদি।
- পুরনো যন্ত্রপাতি যেগুলো খুব উচ্চ আওয়াজ সৃষ্টি করে তা পরিবর্তন করে নতুন যন্ত্র স্থাপন করা দরকার।
- Sound observer use করা।
- বেশি sound produce যন্ত্রে রেপার বা আবরক ব্যবহার করা।
৩. পরিবেশগত উপায়:- অতিরিক্ত সাউন্ড বা শব্দ প্রতিরোধ করতে গাছ sound observer হিসাবে কাজ করে। তাই শব্দ দূষণ প্রতিরোধে অশোক, বট, পাকুড়, নিম গাছ লাগানো উচিত।
৪. সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ:-
A.সচেতনতা বৃদ্ধি:
টিভি, বেতার ,টেলিভিশন সংবাদপত্র ও বেতারের মাধ্যমে জনগণকে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কেএবং শব্দ দূষণের ভয়ংকর অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে।
B. শব্দ দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মিটিং, মিছিল, আন্দোলন এবং সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ কে মান্যতা দিতে হবে।
ব্যবহার না করার সময় যন্ত্রপাতি বন্ধ করে, ভলিউম কমিয়ে, বেশি গাছ লাগানো, যানবাহন ও মেশিনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা শব্দ দূষণ কমাতে পারি।
শব্দ দূষণ বলতে সেই সমস্ত অত্যাধিক আওয়াজকে বোঝানো হয় যার ফলে মানুষের বা অন্য কোন প্রাণীর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমরা বিভিন্ন ধরনের দূষণ সম্পর্কে জানি যেমন - বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ ইত্যাদি। কিন্তু মহাকাশ দূষণ এক প্রকার দূষণ নয়।
* যানবাহন থেকে নির্গত শব্দের মাত্রা কমানো
* শিল্প থেকে নির্গত শব্দের মাত্রা কমানো
* নির্মাণ কাজের সময় শব্দের মাত্রা কমানো
* বিনোদনমূলক কার্যকলাপের সময় শব্দের মাত্রা কমানো
* জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে জানানো
শব্দ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা। এটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ক্ষতি করে। আমরা সকলেই শব্দ দূষণের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারি।